Saturday, January 04, 2014

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এবং নারী নির্যাতন


Sexual Health..
প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে সেই স্বাস্থ্যকে বুঝায় যার মাধ্যমে মানুষ তথা নারী-পুরুষ উভয়েই স্স্থু ও নিরাপদভাবে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে, স্স্থুভাবে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা রাখে ও তা কখন ও কিভাবে করবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা অর্জণ করে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার হলো নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে যৌন ও প্রজনন সংক্রান্ত যেকোন প্রসঙ্গে নিজস্ব সম্মতি ও নির্বাচনের অধিকার। অর্থাৎ,গর্ভধারণ,পরিবার পরিকল্পনা ও পদ্ধতি নির্বাচন,স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্ক ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে উভয়ের মতামত,আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার রয়েছে। কিন্তু,বাংলাদেশের নারীরা কি আদৌ এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন? না রাখেন না। আর না রাখার ফলে যা সাধারণত ঘটে তাকেই আমরা একভাবে নির্যাতন বলে চিহ্নিত করতে পারি।

১.

একজন এইচআইভি আক্রান্ত পুরুষকে ও তার স্ত্রীকে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিষেধ করে দিয়েছে কোন ধরনের শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে।স্ত্রীকে ভালভাবে তারা বুঝিয়েও গিয়েছে। কিন্তু দেখা গেল স্ত্রীও এইচআইভি‘তে আক্রান্ত হলেন।আমি যখন তাঁর সাথে কথা বলতে গেলাম,তিনি জানালেন,‘‘আফনেরে লজ্জার কথা কি কমু!আমারে তো ডাক্তার আফারা মানা কইরা গেছিলো,কিন্তু হ্যায় তো আমার কথা মানেনা।হ্যায় কইছে,চুপ কইরা থাক।তুই আমার বউ আমার কথা মানবি।মাইনষের কথা এত ধরছস ক্যান?’’ এই ব্যক্তি হাজার কনসাল্টেন্সির পরেও কনডম ব্যবহারও করেনি।ফলে উনি মারা গেছেন আর ভাইরাসটি নিষ্ঠার সাথে দিয়ে গিয়েছেন তার স্ত্রীকে যাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে দুই সন্তানের দেখাশুনা করতে হয়।গ্রামের সবাই এই মহিলাকে ‘খারাপ মেয়েছেলে’ মনে করে। কারণ তারা জানে যে স্বামী ছাড়া অন্য কারও সাথে শুলেই বা অনেক পুরুষের সাথে শুলেই এই ‘রোগ’ হয়। নানা অপবাদ আর হেনস্তার মাঝে তার জীবন কাটছে।

২.

একজন ১৬ বছর বয়সী নারী গার্মেন্টস কর্মী;বিয়ের পরই স্বামী কোন পদ্ধতি ব্যবহার না করেই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে যান। স্ত্রী যতবারই বলেছে কনডম ব্যবহার করতে ততবারই তার স্বামী অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছে এবং মারধোর করেছে। মারধোর করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সময় অনেক সময় স্ত্রী অজ্ঞান হয়েও যেতো। তারপর যখন স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হলো তখন তাকে সন্তান নষ্ট করে ফেলতে বললো। ডাক্তার জানালেন এত অল্প বয়সে সন্তানধারণ করা যেমন বিপদজনক;তেমনি গর্ভনষ্ট করাও বিপদজনক। আর প্রথম সন্তানের  ক্ষেত্রে তো আরও বিপদজনক। হিতে বিপরীত হলো। স্বামী ডাক্তারের সম্মতি না পেয়ে কিছু বুদ্ধিদাতার যারা ওষুধ ও শেকড় দিয়ে গর্ভপাতের পরামর্শ দিলো। স্ত্রীর ওপর জোরজবরদস্তি শুরু হলো। তারপরেও স্ত্রীর গর্ভ যখন নষ্ট হলো না তখন স্বামী স্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই বারবার যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতো। অপুষ্ট শিশুর জন্ম হলো এবং স্ত্রীর স্বাস্থ্য (মানসিক ও শারীরিক) ক্রমশই ভেঙে যেতে লাগলো। স্ত্রীকে পিল খেতে বলল স্বামী;কিন্তু পিল খেয়ে তার শরীর আরও দুর্বল হতে থাকলো। বাঁধ্য হয়ে যখন পিল খাওয়া বন্ধ করে দিলো তখন সে আবার সন্তানসম্ভবা হলো।

৩.

ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর ডাক্তার স্ত্রী। বিয়ের পর যতবারই স্ত্রী চেয়েছে ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা অন্যান্য বিষয়ে মতামত দিতে ততবারই শুনতে হয়েছে..‘এসব নিয়ে তুমি তোমার রোগীদের বলো। আমাদের মধ্যে এত কথার কি আছে;আমি যখন মনে করবো সন্তান নেয়ার সময় হয়েছে তখন তো তোমাকে বলবোই।’স্ত্রী যখন জানিয়েছেন যে পিল ব্যবহারে তার শারীরিক কিছু সমস্যা হচ্ছে,তখনও স্বামী কনডম ব্যবহারে অস্বীকৃতী জানায়।

৪.

মহিলাদের ‘কাঠি,কপার-টি’ ইত্যাদি নানা ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করানো হচ্ছে। প্রতিটিই পদ্ধতি হিসেবে অত্যন্ত ভয়াবহ;কিন্তু ব্যবহারকারী সব মহিলার একই কথা,স্বামীরা জোর করে নিয়ে এসেছে। অনেকে আবার লুকিয়ে এসে খুলেও গিয়েছে ব্যথা লাগে বলে;কিন্তু আবার তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই পরতে হয়েছে।

এরকম হাজারও ঘটনা ঘটছে আমাদের খুব কাছেই। না, এটি শুধু ‘নিরক্ষর’ মানুষের বেলাতেই ঘটছে না;বরং সকল শ্রেণীতেই ঘটছে। কারণ পুরুষের পরিচয়  শুধু পুরুষই। আর নারীর পরিচয় হয়ে উঠেছে ‘অধস্তন’। পাবলিক-প্রাইভেট সব পরিসরেই যত শিক্ষিত,স্ব স্ব ক্ষেত্রে যতই ক্ষমতাশালী হয়ে থাকুক না কেন তাদের কন্ঠস্বর খুব কম ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করতে পারে বা প্রতিরোধ করে সফল হতে পারে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা,সম্মতি,মতামত এসবই সমানভাবে গুরুত্বের দাবি রাখে। আর গুরুত্ব না দিয়ে নারীকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় প্রতি মুহুর্তে;সেই সাথে থাকে অবহেলা আর তুচ্ছ করার প্রবণতা যা আমাদের সামাজিক কাঠামোরই প্রতিচ্ছবি মাত্র। এই অবহেলায় বাড়ছে মাতৃমৃত্যুর ও শিশু মৃত্যুর হার, বাড়ছে গর্ভপাতের হার।একজন নারী যার দেহে জন্ম নিবে সন্তান তার সিদ্ধান্ত নেবার কোন অধিকারই নেই যে কখন,কোথায়,কিভাবে জন্ম হবে শিশুটির বা কোন পদ্ধতি তিনি আদৌ ব্যবহার করতে চান কি চান না,সঙ্গমে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাৃ.!!! নারী দেহটি যেন প্রকৃত অর্থেই পুনরুৎপাদনের একটি যন্ত্র বিশেষ! যন্ত্রটিতে প্রয়োজনমত শুধু প্রোগ্রাম করে নেওয়া,কি প্রোগ্রাম হবে তা শুধুই নির্ভর করবে প্রোগ্রামকর্তার ওপরে!! বিয়ের বৈধতাই যেন ওখানে,স্ত্রী দেহের ওপর একান্ত আধিপত্য।অথচ সম্পর্খটি যে আদৌ আধিপত্যের নয়,ভালবাসা আর বিশ্বাসের,তা বোঁধকরি এ্খানে অতি নগণ্য। স্ত্রীর অনিচ্ছায় জোর করে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া যে ধর্ষণেরই আরেক নাম তা বোঁধকরি অনেকেই মানেন না।ঠিক তেমনি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে  নারীর অবদমিত ও অধস্তন  অবস্থান যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ তাও বোঁধকরি সকল মহলেই সমানভাবে অগ্রহণযোগ্য।

সাম্প্রতিককালে অনেক নামজাদা প্রতিষ্ঠান ও ‘সুশীল’ সমাজের তুখর নেতৃবৃন্দ নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সোচ্চার। নারীকে তার অধিকার সম্বন্ধে জানাতে হবে,ফলে তারা  প্রতিরোধ করতে পারবে। অথচ সামাজিক চর্চা,অভ্যস্ততা সর্বপরি আমাদের সামাজিক কাঠামো ও মানসিকতার পরিবর্তন সর্বপ্রথম অনিবার্য। হাজার হাজার অর্থ বরাদ্দ নিয়ে সভা, কর্মশালা,গবেষণা করে নারীকে জানিয়ে কি আদৌ কোন লাভ আছে যখন নারী বেশিরভাগ সময়েই প্রতিরোধ করার পরিস্থিতিতে থাকে না?নারী-পুরুষ উভয়েই জানলো অথচ তাদের চর্চা সেই আগের জায়গাতেই রয়ে গেল;কার কি হবে?তাই সবার আগে আমাদের সবাইকে একে অন্যকে সম্মান দিতে শিখতে হবে,তা নারীই হোক আর পুরুষ।যেকোন সম্পর্ককেই যদি সম্মান দেয়া না যায়,তবে নির্যাতন আদৌ বন্ধ হওয়ার নয়। তাই শুধু যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার সম্পর্কে জানলেই হবে না;এই অধিকার বাস্তবায়নের উপযুক্ত পরিস্থিতি আমাদেরকেই গড়ে তুলতে হবে।অন্য কেউ করবে না ভেবে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঘর থেকেই,নিজেদের চেনাজানা গন্ডিতে এই চর্চা শুরু করি;তবেই একদিন সব ঘরেই সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা ও নির্যাতন বন্ধ করা হয়তো সম্ভব হবে।

First Published Fairnews24.com, Health News

No comments:

Post a Comment