Monday, December 02, 2013

ডিজে পার্টিতে সিসার নেশায় উন্মাতাল তরুণ-তরুণীরা

নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে লেজার লাইটের ঝলকানি। হিন্দি ও ইংরেজি পপ গানের কান ফাটানো শব্দ। এর মধ্যে সিসা আর সিগারেটের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আর নেশার ঘোরে চলছে বেসামাল তরুণ-তরুণীদের উন্মাতাল নাচ। রাজধানীতে নিত্যদিনের ডিজে পার্টিতে এটা এক সাধারণ দৃশ্য। প্রতিরাতেই বেশ কিছু কমিউনিটি সেন্টার, সামাজিক ক্লাব ও পাঁচ তারকা হোটেলে চলে এ ধরনের পাটি। আর ডিজে পার্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এখানে আসা যুবক-যুবতীরা মেতে ওঠে জমজমাট সিসা, মদ ও ইয়াবা সেবনে। এক মাস ধরে চালানো যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ডিজে পার্টির অন্দরমহলের সেসব অজানা কাহিনী। ‘ডিজে’ মানে ডিস্কো জকি। অর্থাৎ গানের তালে তালে নাচের উন্মাদনা তৈরির জন্য মাইক্রোফোনের মাধ্যমে যারা নানা ধরনের উত্তেজক শব্দ উচ্চারণ করে তারাই ডিস্কো জকি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীতে ডিজে পার্টি আয়োজনের শীর্ষে রয়েছে তিনটি গ্র“প। এরা ডিজে পার্টির নামে সিসা, অবৈধ মদ ও ইয়াবাসহ মাদক সেবনের নিয়মিত আড্ডা বসাচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, এই তিন গ্র“পের এক নম্বরে আছে জামিল, নাতাশা, টুম্পা ও ডিজে লেমন গ্র“প। ব্ল্যাক আই এন্টারটেইনমেন্ট নামের অখ্যাত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে এরা বিভিন্ন ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার ও পাঁচ তারকা হোটেলে ডিজে পার্টির আয়োজন করছে। গত ৮ জুন হোটেল র‌্যাডিসনে এদের আয়োজিত ডিজে পার্টিতে অংশ নেয়া উচ্ছৃংখল যুবকরা মাতাল অবস্থায় রাস্তায় নেমে আসে। তারা পথচারীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় নৌবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাদের হাতে লাঞ্ছিত হন। এ ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় জিডি হয়। ডিজে পার্টি আয়োজনের নামে মাদক সেবনের আড্ডা বসানোর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে, ব্ল্যাক আই এন্টারটেইনমেন্টের স্বত্বাধিকারী জামিল হুসাইন ওরফে ডিজে জামিল যুগান্তরকে বলেন, তাদের ডিজে পার্টিতে কোনো ধরনের মাদক সেবন করা হয় না। তবে অনুষ্ঠানে যারা আসেন তারা মদ-বিয়ার পান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীতে ডিজে পার্টির আয়োজক আরেকটি গ্র“প হচ্ছে রাকিব, মনীষা, পরী ও নোমান গ্র“প। এরা হোটেল রিজেন্সি, ওয়েস্টিন ও র‌্যাডিসনে দীর্ঘদিন ধরেই ডিজে পার্টির আয়োজন করে আসছে। গোয়েন্দা পুলিশের তালিকায় আরেকটি গ্র“পে আছে ডিজে বাদল, মনসুর ও শাহরিয়ার। এরা বিভিন্ন সামাজিক ক্লাবের হলরুম ভাড়া নিয়ে ডিজে পার্টি আয়োজনের আড়ালে মাদক সেবনের আড্ডা বসিয়ে আসছে।


ডিজে পার্টির অন্দরমহলে :  ১৫ তলা এ ভবনের ১২ তলায় ডিজে পার্টির আয়োজন চলছে। ভবনের নিচে প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা। ভবনের কিছুটা দূরে পুলিশের অবস্থান। ভেতরে তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ঘরের মাঝখানে খোলা জায়গায় হিন্দি গানের তালে তালে তরুণ-তরুণীদের উন্মাতাল নাচ। ঘরের বিভিন্ন কোনায় টেবিল-চেয়ার পাতা। সেখানে বসে অনেকেই রাংতার পাতায় সাজিয়ে নিচ্ছেন ইয়াবার গুঁড়ো। এরপর রাংতার নিচে ম্যাচের কাঠির আগুন দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ধোঁয়া। সেই ধোঁয়া বিশেষ একটি চোঙ্গার মাধ্যমে মুখ দিয়ে নয়, নাক দিয়ে টেনে নেয়া হচ্ছে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে তাদের নেশাগ্রস্ত চেহারা লাল হয়ে উঠেছে। এক কোণে সিসার আসর বসেছে। বড় বড় কয়েকটি সিসার পাত্র সাজিয়ে নল দিয়ে ধোঁয়া টানছেন কয়েকজন কিশোর-কিশোরী। ঘরের এক কোণে বড় একটি কাঠের তাকে সাজিয়ে রাখা নানা ব্র্যান্ডের বিদেশী মদ-বিয়ার। ৫/৬ জন বেয়ারা গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢেলেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ভেতরে এই যখন অবস্থা তখন হঠাৎ একজন ‘মাস্তান’ হাজির হলেন মদ বিক্রির কাউন্টারে। তিনি কোমর থেকে পিস্তল বের করে রাখলেন টেবিলের ওপর। এবার পুরো একটি মদের বোতল দিয়ে দিতে বললেন। এতে গণ্ডগোল বেধে গেল। হইচই থামাতে এগিয়ে এলেন পার্টির নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বিশেষ টিম (বাউন্সার)। তারা অস্ত্রধারীকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অস্ত্রধারী মোটেও দমলেন না। এবার তিনি আরও উদ্ধত হয়ে তার অস্ত্রটি উঁচু করে ধরে বললেন, ‘আমি ছাত্রলীগের নেতা। এখানে পার্টি চালাতে হলে আমাকে মদ দিতে হবে। একপর্যায়ে তিনি এক বোতল মদ ও ইয়াবাসহ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে একটি টেবিল দখল করলেন। ওদিকে ইয়াবা আর সিসার নেশায় উন্মত্ত আরেকজন মাঝবয়সী। তিনি একজন তরুণীকে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরেছেন। তরুণীটিকে তিনি বাইরে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু পার্টির আয়োজকরা বাইরে মেয়ে নিয়ে যেতে দিতে রাজি নন। এ নিয়ে কিছুক্ষণ ওই মাঝবয়সীর সঙ্গে পার্টির আয়োজকদের ধস্তাধস্তি হল। এ অনুষ্ঠানে দেখা যায় ডিজে হিমু, বাপ্পি, আনার, মারুফ, সুমি, রাজন, প্রিয়া ও ডিজে আরিনকে। তারা নেচে চলেছেন বিভোর হয়ে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্টিতে অতিথিও বাড়তে থাকে। আয়োজকদের একজন জানালেন পার্টি চলবে ভোর ৪টা পর্যন্ত।
রাতভর পার্টি দিনভর ঘুম : এই ডিজে পার্টিতে কথা হল রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফারজানা খান নিঝুমের সঙ্গে। তিনি জানান, সপ্তাহের দু’একটা দিন বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে ডিজে পার্টিতে তিনি স্ট্রেস (অবসাদ) কাটাতে আসেন। এতে অন্যদিনগুলোতে পড়ালেখার এনার্জি পান। তবে ডিজে পার্টি থেকে ফিরে পরদিন তিনি ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারেন না। পরের দিনটা ঘুমিয়ে কাটান। নিঝুমের সঙ্গে পার্টিতে এসেছেন তার বয়ফ্রেন্ড মনজুর মোর্শেদ সেজান। তিনি বলেন, ঢাকায় আনন্দ করার মতো জায়গা নেই। তাই ডিজে পার্টি দেয়া উচিত। পুলিশ ও র‌্যাবের ভয় নিয়ে পার্টিতে আসেন বলে পার্টি পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন না। সংক্ষিপ্ত কথার মাঝে মাঝে তিনি বুকভরে সিসার ধোঁয়া নিচ্ছিলেন। আর তার বান্ধবী নিঝুমের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ : ডিজে পার্টির অনুষ্ঠানস্থলের কিছুটা দূরেই উত্তরা পশ্চিম থানার ৬ জন পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব পালনরত এসআই (উপপরিদর্শক) সাইদুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করা হয়, এখানে অবৈধ মাদকের আড্ডা চললেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? জবাবে তিনি বলেন, যেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে সেটির মালিক এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলে। তাই এখানে অভিযান চালানোর ক্ষমতা তাদের নেই। বরং তারা এসেছেন নিরাপত্তা দিতে। বহুতল ওই ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী শহিদুল জানান, ভবনের ১২ ও ১৩তম ফ্লোরের মালিক একজন প্রতিমন্ত্রীর ছেলে। তাই এখানে পুলিশ বা র‌্যাব কখনোই আসে না। ডিজে পার্টির আয়োজক শাহরিয়ার জানান, ‘এ জায়গাটি নিরাপদ হওয়ার কারণে এখানে নিশ্চিন্তে তারা অনুষ্ঠান করতে পারেন। তাই টিকিট বিক্রিও জমজমাট। আয়োজক মুনসুর জানান, প্রতি রাতে অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি থেকে তাদের এক/দেড় লাখ টাকা আয় হয়। এর বাইরে মদ, বিয়ার, ইয়াবা ও সিসা বিক্রি থেকে আরও লাখখানেক থাকে।’ তিনি বলেন, জায়গাটা প্রতিমন্ত্রীর ছেলের হলেও থানাকে খুশি রাখতে হয়। এসআই জহির ও এসআই এমদাদ থানার ‘বকশিশ’ নিয়ে যান।
অনুমোদনবিহীন : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অধ্যাদেশ অনুযায়ী রাজধানীতে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হলে পুলিশের অনুমোদন নিতে হয়। অুনুষ্ঠানের প্রকৃতি বিবেচনা করে সন্তুষ্ট হলে অনুমতি দেয় পুলিশ। মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখা থেকে জানানো হয়েছে, ডিজে পার্টিগুলো পুলিশের অনুমোদনের তোয়াক্কা করে না। তারা কোনো না কোনো প্রভাবশালীকে ম্যানেজ করে তার ছত্রছায়ায় অনুষ্ঠান আয়োজন করে। আর পাঁচ তারকা হোটেলে ডিজে পার্টি আয়োজিত হলে সেখানে অবস্থানরত বিদেশী অতিথিদের বিষয়টি বিবেচনা করে পুলিশকে নীরব থাকতে হয়। তবে সূত্র জানিয়েছে, সরকারদলীয় একজন প্রভাবশালী নেতার ছেলে পুলিশের বিষয়টি সামাল দেন। পার্টিতে পুলিশি ঝামেলা হবে না বলে তিনি নিশ্চয়তা দেন। বিনিময় তাকে ‘সুবিধা’ দিতে হয়। ডিজে পার্টির আয়োজকদের কয়েকজন যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘প্রভাবশালী ওই রাজনীতিকের ছেলেকে ‘সুবিধা’ দেয়া হলে পার্টিতে পুলিশ বা র‌্যাব ঝামেলা করে না।’ পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গুলশান ও বনানী এলাকায় অনুষ্ঠিত ডিজে পার্টির জন্য কেউ পুলিশের অনুমতি চান না। তবে থার্টিফার্স্ট নাইটের (৩১ ডিসেম্বর রাতের) অনুষ্ঠান করার সময় পুলিশের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন আসে। এসব আবেদনেও ডিজে পার্টি না লিখে ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’-এর জন্য অনুমতি চাওয়া হয়। জানতে চাইলে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবির যুগান্তরকে বলেন, অনেক ডিজে পার্টিতে মাদক বেচাকেনার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। খবর পাওয়া মাত্র তারা অভিযান চালান। কোনো ছাড় দেয়া হয় না। ওদিকে ডিজে পার্টি সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, যেখান থেকে মাসোয়ারা পেতে বিলম্ব হয় পুলিশ শুধু সেখানেই অভিযান চালায়। মূলত পুলিশকে ম্যানেজ করেই ডিজে পার্টি চলে।
অভিযান চালাতে গিয়ে : সূত্র জানিয়েছে, ডিজে বাদল, মনসুর ও শাহরিয়ার গ্র“প উত্তরা ৩নং সেক্টরে নিয়মিত ডিজে পার্টির নামে সিসা, ইয়াবাসহ মাদক সেবনের জমজমাট মাদক ব্যবসার আয়োজন করে এটা সবারই জানা।  এরপর নিতান্ত বাধ্য হয়ে  সেখানে অভিযান চালাতে যান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অভিযান না চালিয়ে রাত ২টায় তারা ফিরে যান। সূত্র জানায়, অভিযান চালানোর সব প্রস্তুতি নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের ফিরে আসতে হয়। কেননা অভিযান পরিচালনার সময় তারা জানতে পারেন বহুতল এ ভবনের ডিজে পার্টি আয়োজনের দুটি ফ্লোরের মালিক সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এরই মধ্যে উপর মহল থেকে একাধিক ফোন আসতে থাকে। এক পর্যায়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা এক রকম পালিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক লুৎফর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তারা পালিয়ে যাননি। প্রথমে তারা ঘটনাস্থল শনাক্ত করতে পারছিলেন না। পরে পর্যাপ্ত ফোর্স না পাওয়ায় কৌশলগত কারণে পিছু হটে আসেন। তবে অভিযান চালাতে গিয়ে কর্মকর্তাদের পালিয়ে আসার বিষয়টি স্বীকার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল যুগান্তরকে বলেন, ‘এই অধিদফতরের একটি অংশ আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এ কারণে ডিজে পার্টির নামে মাদকের আড্ডায় অভিযান চালাতে গিয়েও তারা বারবার ফিরে আসেন। ওইদিন রাতে তো তারা রীতিমতো পালিয়ে আসেন।’
তিনি বলেন, ‘উল্টো আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তারা সেই রাতে পর্যটন কর্পোরেশনের আওতাধীন একটি বারে ‘হামলা’ চালিয়েছে। তাদের এই আচরণ রহস্যজনক এবং এতে আমার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে।-এফএনএস 

No comments:

Post a Comment